Magic Lanthon

               

মাসুদ পারভেজ

প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

কুশীলবের খোঁজে

মাসুদ পারভেজ


জীবন একটা রঙ্গমঞ্চ। এখানে সবাই কুশীলব, যে যার মতো অভিনয় করে যাচ্ছে¾এ রকম কথা হরহামেশাই শোনা যায়। বিশেষ করে মানুষ যখন সঙ্কটের মুখোমুখি হয়, আর অতিপরিচিত থেকে স্বল্পপরিচিত¾সবাই না চেনার ভান করে, তখন সেই সঙ্কটের মুখে পড়া মানুষটি খোঁজে এই ভান করা মানুষের পূর্বের রূপ। পূর্বের রূপের সঙ্গে ভান করা রূপের মিল সে পায় না। আর তখনই মনে হয়, জীবনে সবাই এক একজন অভিনেতা-অভিনেত্রী। জীবনের এই অভিনয়ের বাইরেও অভিনয় করে মানুষ। এই অভিনয় মঞ্চের, এই অভিনয় পর্দার, এই অভিনয় বোকা-বাক্সের। ‘অভিনয়ের জন্য অভিনয়’ বললে, এই সব অভিনয়ের খোঁজ পাওয়া যাবে না। খোঁজ করতে হলে ইতিহাস, সভ্যতা ছাড়াও প্রাগৈতিহাসিকতার পথে হাল ঘুরাতে হবে।

২.

আদিম মানুষ দলবদ্ধভাবে আত্মরক্ষা বা অভিযোজন করতে চেষ্টা করেছে, দলবদ্ধভাবে আহরণ ও শিকার করেছে, দলবদ্ধ হয়ে অতিপ্রাকৃত শক্তিকেদেব-দেবী ভূত-প্রেতদের তুষ্ট করবার জন্য অনুষ্ঠান করেছে, যৌথভাবে আনন্দ উপভোগ করেছে এবং দুঃখ দুর্ভোগের বেদনা ভোগ করেছে। যেন ভিন্ন ভিন্ন দেহের ভিতর দিয়ে একটি মনই কাজ করে গেছে।

আদিম মানুষের এই সব চারিত্রিক বিষয়-আশয়ের মধ্যে একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার, আর তা হলো¾দলবদ্ধ হয়ে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে¾দেব-দেবী, ভূত-প্রেতদের তুষ্ট করবার জন্য অনুষ্ঠান করার ব্যাপারটি। এখানে তাদের স্বাভাবিক জীবনের বাইরে যে ব্যাপারটি পাওয়া যায়, সেখানে তারা সামষ্টিক চেতনার (Collective Consciousness) পরিচয় দেয়। অতিপ্রাকৃত শক্তিকে তুষ্ট করবার জন্য যে অনুষ্ঠান, এটার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় অভিনয়ের একটা প্রেক্ষাপট। যা পরবর্তীকালে মিশর, গ্রিস, ভারতে দেবতাকে তুষ্ট করতে নাট্যাভিনয়ের মধ্যে বিষয় হয়ে এসেছে। ‘আদিম সমাজে ব্যক্তির নৈয়ায়িক বুদ্ধির মাত্রা খুবই কম এবং কম বলেই, তারা প্রত্যেকে ঘটনার বা কার্যের কারণ হিসাবে অদৃশ্য ও অলৌকিক শক্তি কল্পনা করেছে, আত্মরক্ষার তাগিদে তাকেই নানা উপায়ে তুষ্ট করতে চেষ্টা করেছে ...’ , এই ‘তুষ্ট’ করার মধ্যেই অভিনয় ছিলো। কিন্তু যেহেতু তাদের নৈয়ায়িক বুদ্ধি কম ছিলো, তাই তারা নিজেরাও সেটা উপলব্ধি করতে পারেনি। বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠে আসে যখন মিশর, গ্রিস আর ভারতে নাটকের অভিনয়ের খোঁজ করা হয়।

খ্রিষ্টের জন্মের দুহাজার বছর আগে, মিশরে নাট্যাভিনয়ের প্রচলন ছিল। জনৈক ইখার্নোফ্রেতের বিবরণ থেকে জানা যায়-তৃতীয় সেকোসট্রিসের (Secostries, 1887-1849 B.C.) সম্মুখে, তিনি প্রাচীন নাট্য থেকে সংগ্রহ করে ওসিরিসের কাহিনীটি অভিনয় করেছিলেন। ওসিরিস কৃষির অর্থাৎ শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা।

গ্রিসে নাট্যাভিনয় এইস্কিলাস বা থেসপিস-এর সময় থেকে আরম্ভ হলেও, এই আরম্ভই নাট্যাভিনয়ের প্রথম আরম্ভ নয়। এর শত বা সহস্র বছর আগেও হয়তো নাট্যাভিনয়ের প্রথা প্রচলিত ছিলো।গ্রিক নাটকের উৎপত্তি হয়েছে ডাওনিসাস উৎসবে এবং ডাওনিসাস কাহিনি আশ্রয় করেই। গ্রিক গোষ্ঠী সমাজের দীক্ষাবিধি থেকেই ক্রমে ডাওনিসাস-উপাসনা এবং তাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে গ্রিক নাটকের। ডাওনিসাস নাটকটিও ‘কৃষি-ইষ্টি’ কথাকেই তুলে ধরেছে। অর্থাৎ ডাওনিসাস কৃষির অভিমানী দেবতা।আর ইন্দ্রোৎসবকে কেন্দ্র করেই ভারতবর্ষে নাটকের জন্ম হয়েছিলো।

প্রাচীন মিশর, গ্রিস ও ভারতে নাট্যাভিনয় ব্যাপারটির সঙ্গে দেব-দেবতার তুষ্টি ও ধর্মোৎসব বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। আর এই ব্যাপারটির সঙ্গে মিল পাওয়া যায় আদিম সমাজের ওই সব মানুষের রীতির, যা তারা দলবদ্ধ হয়ে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে¾দেব-দেবী, ভূত-প্রেতদের তুষ্ট করার জন্য করতো। মিশরে কৃষির দেবতা ওসিরিস’কে, গ্রিসে কৃষির অভিমানী দেবতা ডাওনিসাস’কে আর ভারতবর্ষে ইন্দ্রকে নাট্যাভিনয়ের বিষয় করা হয়েছে। তাহলে বলা যায়, আদিম মানুষের অতিপ্রাকৃত শক্তিকে তুষ্ট করার বিষয়টি একধরনের নাট্যাভিনয়। মানুষের এই অভিনয় প্রবণতা কিংবা ক্ষমতা তাহলে প্রাগৈতিহাসিক পর্যায় থেকেই ছিলো।

৩.

একটা অতিপরিচিত গল্পের কথা ধরা যাক। এক রাখাল বালক বনের পাশে গরু নিয়ে যেতো ঘাস খাওয়াতে। বন থেকে কিছুটা দূরে কিষাণেরা মাঠে কাজ করতো। দিনের কোনো একসময় রাখাল বালক¾বাঘ, বাঘ বলে চিৎকার করতো। রাখালের চিৎকার শুনে তাকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে আসতো কৃষক ও গ্রামবাসী। কিন্তু তারা এসে দেখতো আশেপাশে কোনো বাঘ নেই এবং রাখাল বালক তাদের ঠকিয়েছে। রাখালের এই পুরো ব্যাপারটি অভিনয় ছাড়া তো আর কিছুই নয়। কারণ, তার সুনিপুণ অভিনয়ের দ্বারা লোকজন, মানে যারা তার চিৎকার শুনতো, তাকে উদ্ধার করতে আসতো। তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হতো, সত্যি রাখাল বালকটি বিপদে পড়েছে।

৪.

এবার আসা যাক চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীর দিকে। যেহেতু চলচ্চিত্র আবির্ভাবের পূর্বে নাটকের আবির্ভাব, তাই কিছুটা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসের জের টানতে হলো। ইউরোপে চলচ্চিত্রের উদ্ভব ঘটে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে আর ভারতবর্ষে তার ঢেউ লাগে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে। ‘উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে নাটক, নাচগান, যাত্রাপালার পাশাপাশি ঢাকাবাসীরা বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার চলচ্চিত্রের প্রথম স্বাদ পায় ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে।’ এখানে একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার যে, ঢাকায় চলচ্চিত্র আবির্ভাবের পূর্বে নাটক, নাচগান ও যাত্রাপালা বিনোদনের একটা বড়ো পরিসর জুড়ে ছিলো। আর গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে পুতুলনাচ, পটের গানও উল্লেখযোগ্য। ঢাকায় চলচ্চিত্র প্রদর্শন ১৯ শতকের শেষ প্রান্তে হলেও পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরি হতে বেশ সময় লেগেছিলো। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল জব্বারের মুখ ও মুখোশ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক বাংলা চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্র প্রদর্শনের কাল হতে নির্মাণ কালের এতো দেরি হওয়ার পিছনে কিছু রাজনৈতিক কারণও ছিলো। তার মধ্যে বঙ্গভঙ্গ রদ অন্যতম। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে ঢাকা রাজধানীর গৌরব হারায়, আর কলকাতা আবারও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের গুরুত্ব নেয়। ‘এ কারণে কোলকাতাই হয়ে পড়ে ছবি নির্মাণের ক্ষেত্র। ঢাকা মেতে থাকে নাটক, যাত্রাগান, পালাগান এবং বাঈজীদের আসর নিয়ে।’ এই সময়ে ঢাকার নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অনেকে শখের বশে অভিনয় করতো।

‘অনেক সময় অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা আসতেন কোলকাতা বা অন্যকোনো স্থান থেকে। ... পেশাদার নাটকে মেয়ে চরিত্রে যারা অভিনয় করতেন তাদেরকে কোলকাতা থেকে আনা হতো। আর অপেশাদার নাটকে ছেলেরাই মেয়ে সাজতো। পরে পতিতা বা বাঈজীদের নেওয়া হয়।’১০

এখানে একটা বিষয় লক্ষ করার মতো যে, তখনো ঢাকায় অভিনয়ের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিলো না। বিশেষ করে অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো উল্লেখ করার মতো।

এসব তো গেলো নাটক-থিয়েটারের কথা। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী ঘটে? ১৯২৭-২৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্যরা সুকুমারী নামের যে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তাতে নায়ক চরিত্রে পুরুষ পাওয়া গেলেও, নায়িকা চরিত্রে কোনো নারীকে পাওয়া যায়নি। ফলে আব্দুস সোবহান নামের এক তরুণ নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে নারী না পাওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়¾সেই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্রে বা নাটকে নারীর অভিনয় কোনো সহজ ব্যাপার ছিলো না। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র দি লাস্ট কিস-এ নায়কের ভূমিকায় ছিলেন খাজা আজমল, আর নায়িকা ছিলেন লোলিতা। এই চলচ্চিত্রের আরেক অভিনেত্রী হলেন চারুবালা।

লোলিতা ও চারুবালা পতিতা ছিলেন। এখানে একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার¾চলচ্চিত্রের শুরুর দিকে নারী-চরিত্রে পতিতা কিংবা বাইজি এনে অভিনয় করানো হয়েছে, ফলে দর্শকদের মনে এটা এখনো গেঁথে আছে¾চলচ্চিত্রে যেসব নারী অভিনয় করে তারা সামাজিকভাবে মেলামেশার উপযুক্ত নয়। আবার ছোটো পর্দার অনেক অভিনেত্রীকে বলতে শোনা যায়¾‘‘বাণিজ্যিক’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে আগ্রহী নয়, তবে ‘ভিন্ন ধারার’’ চলচ্চিত্র হলে তিনি প্রস্তাব বিবেচনা করবেন। অভিনয়শিল্পীরা যদি নিজেরাই প্রশ্ন তৈরি করেন, তাহলে সাধারণ দর্শক, যারা চিত্রজগৎ সম্পর্কে পুরোপুরি জানে না, তারা তো সেই ৩০-এর দশকের ধারণা মাথায় রাখতেই পারে।

যদিও এই শিল্পীদের কেউই ‘‘বাণিজ্যিক’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করলে তাদের কী জাত যাবে, সে বিষয়টা পরিষ্কার করেন না! তার মানে, ব্যাপারটাকে অনেকখানি জোর করে উপস্থাপন করা হচ্ছে যে¾বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে যারা অভিনেত্রী, তারা সেই লোলিতা কিংবা চারুবালার দলে। কিন্তু থিয়েটার কিংবা মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে কিংবা ছোটো পর্দায় অভিনয়ের ক্ষেত্রে তেমনটি শোনা যায় না। তবে এমন প্রেক্ষাপট তৈরির পিছনে বাঙালি মুসলমান সমাজের কিছু ব্যাপার ছিলো। প্রথম বাঙালি মুসলিম অভিনেত্রী হিসেবে চলচ্চিত্রে আসেন রোকেয়া খাতুন। রোকেয়া খাতুন ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে তৎকালীন বাংলাদেশে অভিনয় করতে পারেননি। অভিনয়ের জন্য তাকে চলে যেতে হয়েছিলো সুদূর লাহোরে।১১

বিভিন্ন মুসলমান অভিনেতাকেও নাম পাল্টে হিন্দু নাম নিয়ে অভিনয় করতে হয়েছে। নির্বাক যুগের চলচ্চিত্রে বাঙালি মুসলমান দলিল আহমদ অভিনয় করেন শ্যামল কুমার ছদ্মনামে, ওবায়েদ-উল হক করেন হিমাদ্রী চৌধুরী, ইসমাইল মোহাম্মদ করেন উদয়ন চৌধুরী, ফতেহ লোহানী করেন কিরণ কুমার এবং কাজী খালেক করেন স্বপন কুমার ছদ্মনামে। এই সময় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বনানী চৌধুরী নামে এক অভিনেত্রীর আবির্ভাব ঘটে কলকাতার চলচ্চিত্রে। তার আসল নাম আনোয়ারা এবং তিনি ছিলেন প্রথম বি এ পাস মুসলমান অভিনেত্রী, যার জন্ম মাগুরায়। লেট দেয়ার বি লাইট (১৯৭০) চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ, এই সময়ের মধ্যে লোলিতা থেকে বনানী চেীধুরীর আবির্ভাব নারী অভিনেত্রীর ভিন্ন চিত্র প্রকাশ করে। বনানী চৌধুরীর শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থান থেকে বোঝা যায়, চলচ্চিত্রে নারী অভিনেত্রী সম্পর্কে যে প্রেক্ষাপট চালু ছিলো তা অনেকটাই পাল্টেছে। যদিও এটা ঘটে কলকাতার চলচ্চিত্রে। কিন্তু অভিনেত্রী ছিলেন বাঙালি মুসলমান ও উচ্চশিক্ষিত।

১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ১৯৫২’’র ভাষা আন্দোলন ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন আনে। তারই ধারাবাহিকতায় আবদুল জব্বার খানের মুখ ও মুখোশ-এর জন্ম। মুখ ও মুখোশ-এর পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করা হয় ঢাকার বিভিন্ন মঞ্চ, বেতার ও শিক্ষায়তন থেকে। নির্মাতা আবদুল জব্বার খান নিজেও অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন আমিনুল হক। তার বিপরীতে নায়িকা হয়ে আসেন চট্টগ্রামের মঞ্চাভিনেত্রী পূর্ণিমা সেন। পূর্ণিমা এর আগে কলকাতায় মঞ্চে নাচতেন ও গাইতেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রামে এসে যোগ দেন ‘রঙ্গনাট্য’ দলে। চলচ্চিত্রটির অন্য দুই সহ-নায়িকা চরিত্রে নির্বাচিত হন জহরত আরা ও নাজমা (পিয়ারী বেগম)। এরা দুজনেই ছিলেন বান্ধবী, পড়তেন ইডেন কলেজে। জহরত আরা বেতারে নাটকও করতেন।১২ এতো গেলো মুখ ও মুখোশ-এর কুশীলবের কথা। তারপর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীর আগমন ঘটতে থাকে। আসিয়া (১৯৬০) চলচ্চিত্রের পরিচালক ফতেহ লোহানী চলচ্চিত্রের নায়িকা নির্বাচন সম্পর্কে বলেন,

১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি। ‘‘আসিয়া’’ কাগজপত্রের কাজ শেষ করে ফেলেছি। একদিন একটি মেয়ে এলেন আমার বাসায় দেখা করতে। ছিপছিপে গড়ন। শ্যামলা রঙা অমায়িক হাসি ছড়িয়ে অভিবাদন জানালেন। বসতে বললাম। উনি বসলেন। কিছু কথা শুরু করবেন কি দিয়ে হয়তো তা ঠিক করতে না পেরে বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছুটা যেন অসহায়ের মতো। আমি সেদিনের সেই দুটি স্বচ্ছ চোখে খুঁজে পেলাম ‘আসিয়া’’কে। নাম শুধালাম। বললেন, হেনা, হেনা লাহিড়ী। আমি বললাম, উহ আজ থেকে আপনি সুমিতা। ছবির সত্যিকার প্রাণ সঞ্চার করেন যারা তারা হচ্ছেন ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী। সেদিনকার সেই অনাড়ম্বর মেয়ে সুমিতার মধ্যে যথেষ্ট প্রতিভা লুকিয়েছিল। আমি ওকে শুধু সাহায্য করেছি মাত্র। এই অচেনা শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে সুমিতার পরিচয় করিয়ে দিতে, দেখিয়ে দিয়েছি মাত্র কোন পথে এগিয়ে যেতে হবে। সুমিতা তার সমগ্র অনুভূতি দিয়ে চরিত্রকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন, রূপায়িত করেছেন। এতে ওর কোনো ক্লান্তি ছিল না বিরাম ছিল না।১৩

সুমিতা ছিলেন মাদারীপুরের রাজনৈতিক কর্মী অতুল লাহিড়ীর স্ত্রী।

মুখ ও মুখোশ-এর পর থেকে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণের আগ্রহ তৈরি হয়। বিশেষ করে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল ‘‘পূর্ব পকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’’ বিল পাস হওয়া এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরায় অভিনয় করেন কাজী খালেক, আনিস (খান আতা) ও তৃপ্তি মিত্র। আকাশ আর মাটিতে (১৯৫৯) অভিনয় করেন কলকাতার প্রবীর কুমার, রুপা মুখার্জী। মাটির পাহাড়-এ (১৯৫৯) রাজিয়া (সুলতানা জামান), রওশন আরা (ডেইজী), ইকবাল, কাজী খালেক অভিনয় করেন। রওশন আরা (ডেইজী) ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। এ দেশ তোমার আমার-এ (১৯৫৯) অভিনয় করেন সুমিতা, আনিস (খান আতা), রহমান, সুভাষ দত্ত। চিত্রা ও রহমান অভিনয় করেন রাজধানীর বুকেতে (১৯৬০)। এছাড়া যে নদী মরু পথেতে (১৯৬১) রওশন আরা, আনিস (খান আতা), নাসিমা খান, হীরালাল, কল্যাণী দাশ গুপ্ত; হারানো দিন-এ (১৯৬১) রহমান, শবনম, মুস্তাফা, আজিম, সুভাষ দত্ত; তোমার আমার-এ (১৯৬১) আমিন, চিত্রা, ইকবাল, আনোয়ার হোসেন, রবিউল, রাণী সরকার; কখনো আসেনিতে (১৯৬১) সুমিতা, শবনম, খান আতা, সঞ্জীব দত্ত, নারায়ণ চক্রবর্তী; সূর্যস্নান-এ (১৯৬২) রওশন আরা, কাজী খালেক, ইনাম আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, নাসিমা খান; চান্দায় (১৯৬২) শবনম, রহমান, মুস্তাফা, সুভাষ দত্ত, সুলতানা জামান, ইনাম আহমেদ, রাণী সরকার; কাঁচের দেয়াল-এ (১৯৬৩) সুমিতা, রাণী সরকার, খান আতা, আনোয়ার হোসেন, ইনাম আহমেদ, পূর্ণিমা সেন; ধারপাত-এ (১৯৬৩) আমজাদ হোসেন, নাসিমা খান, কাজী খালেক, সুজাতা, সালেহা, সিরাজ, হাসান ইমাম; সংগম-এ (১৯৬৪) রোজী, হারুন, সুমিতা, খলিল, বদরুদ্দীন, মায়া দেবী, রাণী সরকার, আনোয়ারা, জাভেদ, আবুল খায়ের; সুতরাং-এ (১৯৬৪) কবরী (মিনা পাল), সুভাষ দত্ত, বেবী জামান, মঞ্জুশ্রী, জেসমি, রাণী সরকার, ইনাম আহমেদ; তানহায় (১৯৬৪) হারুন, শামীম আরা, সুমিতা, শবনম, নাসিমা খান, শেখ হাসান; অনেক দিনের চেনায় (১৯৬৪) সুলতানা জামান, তন্দ্রা ভট্টাচার্য, হাসান ইমাম, সিরাজ, তুলিপ, কাপি খান, রবিউল, এহতেশাম এবং নদী ও নারীতে (১৯৬৫) রওশন আরা, কাজী খালেক, মাসুদ, সুভাষ দত্ত, মুস্তাফা অভিনয় করেন।

মুখ ও মুখোশ-এর আগের ও পরের এই কয়েক বছরে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট বেশকিছু বিষয়কে ইঙ্গিত করে : স্বল্পদৈর্ঘ্যরে সুকুমারীতে অভিনয়ের জন্য কোনো নারী পাওয়া যায়নি। পুরুষকে দিয়েই নারী-চরিত্রের চিত্রায়ণ করা হয়। তার পর দি লাস্ট কিস-এ নারী-চরিত্রের জন্য যেসব নারী আসে তারা যৌনকর্মী। এই দৃশ্যপট পাল্টে যায় মুখ ও মুখোশ-এ। আর এরপর তা আরো পাল্টে যায়। উপরের চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীর তালিকা থেকে তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। আসিয়ায় সুমিতার আবির্ভাব আরেকটি নতুন পথ তৈরি করে। আর তা হলো¾সুমিতা ছিলো বিবাহিত। সেক্ষেত্রে বিবাহিত সত্ত্বেও চলচ্চিত্রে অভিনয় করা, তাও আবার পরিচালকের কাছে নিজে এসে পরিচিত হয়ে!

তবে এই কয়েক বছরে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তালিকা থেকে দেখা যায়, কিছু নামই ঘুরে-ফিরে এসেছে। নারীদের উপস্থিতিও আরেকদিক থেকে আশার সঞ্চার করে, তা হলো তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা। মুখ ও মুখোশ-এ অভিনেত্রী জহরত আরা ও নাজমা (পিয়ারী বেগম) ছিলেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী। পিয়ারী বেগম তার অভিনয়ে আসা নিয়ে বলেন, ‘‘মুখ ও মুখোশে অভিনয় করার সময় আমি ইডেন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বাবা কিছুতেই অভিনয় করতে দিতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু জব্বার সাহেবের অনুরোধেই আসলে বাবা অনুমতি দিলেন।’১৪ এখানে একটা বিষয় খেয়াল করার মতো, অভিনয়ে আসার জন্যে বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীকে যেমন পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো, তেমনই এখনো অনেক অভিনেত্রীকে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলতে শোনা যায় অভিনয়ের শুরুতে তাদের পারিবারিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কথা।

পারিবারিক এই বাধার কারণ আসলে কী? কিংবা যখন তারা প্রতিষ্ঠা পায়, তখন কেনো আর বাধা দেওয়া হয় না? কিংবা পারিবারিকভাবে বাধা দেওয়ার কথা বলাটা ফ্যাশন কি না? মাটির পাহাড়-এর রওশন আরা ছিলেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। ওই কয়েক বছরে অভিনয়ে আসা কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী বেশ দাপটের সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এরা হলেন¾সুমিতা, শবনম, রহমান, মুস্তাফা, খান আতা, আজিম, সুভাষ দত্ত, আনোয়ার হোসেন, বেবী জামান, আনোয়ারা, রাণী সরকার, খলিল, হাসান ইমাম, কবরী, সুচন্দা, সুজাতা, সাইফুদ্দিন, হাসমত প্রমুখ। এদের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আরো নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীর আগমন ঘটে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য¾রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, ববিতা, শাবানা, আজিম, এ টি এম শামসুজ্জামান, আবদুল্লাহ আল মামুন, শওকত আকবর, প্রবীর মিত্র, আলমগীর, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আহমেদ শরীফ, ইলিয়াস কাঞ্চন, ওয়াসিম, রাজীব, কবিতা, জাফর ইকবাল, টেলি সামাদ, নূতন, মায়া হাজারিকা প্রমুখ।

৫.

১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ‘‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’’-এর রঙিন সম্প্রচার শুরু হয়। এই সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে শিল্পী সঙ্কটের পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় লক্ষ করা যায়। ওই সময়ে টেলিভিশনে নির্মিত নাটকের কলাকুশলীরা মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন এবং তখন একটা পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বেড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট ছিলো। বিশেষ করে ঢাকায় মধ্যবিত্তশ্রেণির যে অংশটা শিল্পসংস্কৃতি চর্চায় যুক্ত ছিলেন, তারাই টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু চলচ্চিত্রাঙ্গনে ছিলো এর ঠিক বিপরীত দশা। শিল্পী সঙ্কট ও অভিনয়শিল্পীদের বয়স বাড়ার কারণে বয়সানুযায়ী চরিত্রায়ণ কষ্টকর হয়ে পড়ে।

তখন বিশেষ করে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে এফ ডি সি থেকে নতুন মুখের শিল্পী খোঁজার কার্যক্রম চালু হয়। নায়ক মান্না ছিলেন যার ফসল। এই নতুন মুখ কার্যক্রমে মুখ পাওয়া গেলেও তারা আসলে সঙ্কট কাটানোর মতো শিল্পী কি না সেটা নিয়ে আরেক সঙ্কট তৈরি হয়। শুধু গ্ল্যামার দিয়ে অভিনয় হয় না, এই বিষয়টা এফ ডি সি’’র চলচ্চিত্রনির্মাতারা হয়তোবা মাথায় রাখেননি কিংবা ইচ্ছা করেই করেন। যার ফল ভোগ করতে হয় দর্শককে। আবারও টানতে হচ্ছে মুখ ও মুখোশ-এর নায়ক আমিনুল হকের প্রসঙ্গ¾চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আগে ঢাকা বেতারের বেশকিছু নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পরও বেতার, টেলিভিশন ও মঞ্চে প্রায়ই অভিনয় করতেন। আমিনুল হক মোট ৩৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।১৫ অর্থাৎ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আগে মঞ্চাভিনয়ের জগতে যুক্ত থাকাটা শিল্পী, শিল্প ও দর্শক¾সবার জন্যই সুখকর। কিন্তু এফ ডি সি’’র নতুন মুখ সন্ধানে সেই সুখকর ব্যাপারটি ঘটেনি। তখন আরো কিছু ঘটনা ঘটে। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের প্রচার-প্রসার বাণিজ্যের কাছে পরাজিত হতে থাকে যাত্রাপালা। যাত্রাপালা থেকে অনেক শিল্পীরও আগমন ঘটে চলচ্চিত্রে এবং এক্ষেত্রেও অভিনয় দক্ষতার চেয়ে গ্ল্যামারকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। যদিও যাত্রার অভিনয় আর চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এ প্রসঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের ‘‘বেদের মেয়ে’’ খ্যাত নায়িকা অঞ্জু ঘোষ একটা উদাহরণ বটে। স্বাধীনতার আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘‘ভোলানাথ অপেরা’’র হয়ে যাত্রায় নৃত্য পরিবেশন করতেন ও গাইতেন অঞ্জু ঘোষ। ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রামের মঞ্চনাটকে জনপ্রিয়তার সঙ্গে তিনি অভিনয় করেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ফোক-ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রনির্মাতা এফ কবির চৌধুরী চলচ্চিত্রে আনেন তাকে। নির্মাণ করেন সওদাগর।১৬

এই সময়ে রুবেল, মান্না, চম্পা, দিতি, জসিম, রানী, বাপ্পারাজ¾এরা নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। বিশেষ করে ইলিয়াস কাঞ্চন তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ঠিক এমনই এক সময় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে পরিচালক এহতেশাম নতুন একজোড়া জুটিকে চলচ্চিত্রে হাজির করেন চাঁদনীর মাধ্যমে। শাবনাজ-নাঈম জুটি সেসময় অভিনয় করেন বেশ কয়েকটি প্রেম-ভালোবাসার কাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্রে। বিশেষ করে ওই সময়ে হিন্দি চলচ্চিত্রে আমির খান, মাধুরি, সালমান, শাহরুখ, জুহি চাওলা কলেজে পড়ুয়া তরুণ-তরুণীর চরিত্র নিয়ে যে ধরনের চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন, শাবনাজ-নাঈম জুটিও সেরকম একটা আবহ তৈরি করেন।

আর এরই ধারাবাহিকতায় সালমান শাহ ও মৌসুমী জুটির আগমন ঘটে। তারপর আমিন খান, ওমর সানি, মেহেদী, শাবনূর, রিয়াজ, শাকিল খান, পপি, ফেরদৌস, পূর্ণিমা এদের আগমন। ইলিয়াস কাঞ্চনের বয়স বেড়ে যাওয়া, রুবেলের অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র, মান্নার সামাজিক অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের বাইরে ওমর সানী, মেহেদী, শাবনূর, রিয়াজ, শাকিল খান, পপি¾এরা অভিনয় করেন প্রেম-ভালোবাসার কাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্রে। সালমান শাহ’’র মৃত্যুর পর রিয়াজ, শাকিল খান, ওমর সানী তার জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করেন। ওমর সানী-মৌসুমী, রিয়াজ-শাবনূর ও শাকিল-পপি জুটি বাঁধে। এদের পর বাংলা চলচ্চিত্রে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মুনমুন, ময়ূরী, পলির আগমন ঘটে। বাংলা চলচ্চিত্রে এই অভিনেত্রীরা ‘‘অশ্লীলতা’’ নিয়ে আসেন বলে দাবি করা হয়।

একই সময়ে আগমন ঘটে শাকিব খানের। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ‘‘অশ্লীল’’ চলচ্চিত্র-নির্মাণ শুরু হলে রিয়াজ, শাকিল খান অনেকেই চলচ্চিত্রে অবস্থান হারান। এরপর ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে নায়ক মান্নার মৃত্যুর পর এফ ডি সি’র চলচ্চিত্রে শাকিব খানের দর বাড়ে। সেসময় শাকিব-অপু জুটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিলো বেশকিছু দিন। বর্তমান অবধি শাকিব খান এফ ডি সি’র সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতা। শূন্য দশকে বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দু-একটি টেলিভিশন চ্যানেল সুপারস্টার খোঁজার প্রতিযোগিতা চালু করে। এ সময় লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার, ‘এটিএন বাংলা’’র নায়িকা খোঁজা প্রতিযোগিতা, ‘এনটিভি’’র সুপার হিরো-সুপার হিরোইন প্রভৃতি নামে এই সব রিয়েলিটি শো চলতে থাকে।

তবে এসব ক্ষেত্রে গ্ল্যামারই মুখ্য ছিলো। রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে চেহারা যাচাই-বাছাই করে দুই-তিন মাসের মধ্যে নায়িকা হয়ে যাওয়া এবং চলচ্চিত্রে অভিনয় করা। মম, বিন্দু, বাঁধন, মীম, নিলয়¾এরা এসব রিয়েলিটি শো’’র মধ্য দিয়েই পর্দায় আসেন। যদিও এই সব প্রতিযোগিতা থেকে আসা বেশিরভাগই প্রথমে চলচ্চিত্রে না এসে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। আর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রসঙ্গ উঠলে তারা ‘‘বাণিজ্যিক’, ‘‘অবাণিজ্যিক’, ‘‘এফ ডি সি’’র চলচ্চিত্র’¾’এসব কথা বলে নাক সিঁটকানো ভাব দেখাতে থাকেন। কিন্তু তারা নিজেরাই যে একটা বাণিজ্যিক পণ্য হয়ে মোবাইলফোনের এস এম এস-এর মাধ্যমে অভিনয়শিল্পী হয়েছেন, সেটা তারা উপলব্ধিও করতে পারেন না! আবার এদের অনেকেই ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, কিন্তু সেটা দর্শক আদৌ চলচ্চিত্র হিসেবে গ্রহণ করে কি না সেটাও তারা বোঝেন না।

৬.

বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীর হাল আমলের অবস্থা আরো নাজুক। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের কাহিনির গভীরতা না থাকায়, নাচ-গান আর হিন্দি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্য থেকে নেওয়া কাহিনির অংশ দেখে অনেকে এখন অভিনয় করেন। এই সময়ে কাজী মারুফ, বাপ্পী চৌধুরী, মাহিয়া মাহি, নীরব, ইমন, আরেফিন শুভ, নিলয়, আনিসুর রহমান মিলন, সায়মন, শিপন, পরীমণি, ববি, আইরিন, প্রসূন আজাদ, অনন্ত জলিল, বর্ষা বাংলা চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করছেন। এদের অনেকেই আবার টেলিভিশন নাটকে কাজ করেছেন। ফলে এদের অনেকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে টেলিভিশন নাটকের সঙ্গে অভিনয়ের পার্থক্যটা ঠিক গুলিয়ে ফেলেন। আবার অনেকে অতিঅভিনয় করতে গিয়ে সেটা যাত্রার ঢঙে ফেলে দেন। তখন সেটা না হয় চলচ্চিত্রের অভিনয়, না হয় নাটক কিংবা যাত্রার অভিনয়।

এটা যেমন একটা সঙ্কট, তেমনই চলচ্চিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারটাও একটা সঙ্কট। আর যে কারণে ছোটো পর্দায় অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত কুশীলবদের সঙ্গে বড়ো পর্দার কুশীলবদের একটা পার্থক্য দেখা যায়। হয়তোবা এই প্রেক্ষাপটও বাংলা চলচ্চিত্রের দুরবস্থার জন্য একটা কারণ। আর এই কারণে ছোটো পর্দার শিক্ষিত অভিনেত্রীরা কিংবা মধ্যবিত্ত দর্শকরা ঢাকাই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের নাম শুনলে নাক সিঁটকান। যদিও বড়ো পর্দার সব কুশীলবের ক্ষেত্রে এই সঙ্কটের কথা খাটে না।

যাহোক, অন্য আরেকটি সঙ্কট এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে চলচ্চিত্রে। চরিত্রাভিনেতা মানে মা-বাবা, চাচা, শিক্ষক চরিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্কট। একসময় রাজ্জাক, শাবানা, ববিতা, আলমগীরকে এসব ভূমিকায় দেখা গেছে। আরো পরে এসব চরিত্রে কাজ করেছেন আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারা, আবুল হায়াৎ, শওকত আকবর, প্রবীর মিত্র, ডলি জহুর, খালেদা আক্তার কল্পনা প্রমুখ। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এদের অনেকের মৃত্যু এবং চলচ্চিত্রে নিষ্ক্রিয়তার কারণে, এসব চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যে ধরনের অভিনেতা-অভিনেত্রী দরকার তা আর পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে কিছু কিছু চলচ্চিত্রে আলীরাজ, কাজী হায়াতকে দেখা যাচ্ছে বাবা চরিত্রে। কিন্তু সেটা মোটেও প্রতুল নয়।

এর চেয়ে আরো ভয়াবহ সঙ্কট হচ্ছে খলচরিত্রের অভিননেতা-অভিনেত্রীর অভাব। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম খল অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন রাজীব, আহমেদ শরীফ, এ টি এম শামসুজ্জামান, জাম্বু, খলিল ও হুমায়ুন ফরীদি। রাজীব, জাম্বু, খলিলের মৃত্যু, হুমায়ুন ফরীদির নিষ্ক্রিয়তা, অতঃপর মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের খল অভিনেতার সঙ্কটকে তীব্র করে। খলচরিত্রে অভিনয়ের জন্য যে ভয়াবহ দাপট আর বীভৎসতা নিয়ে তারা পর্দায় হাজির হতেন, পরে তেমন আর পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে মিশা সওদাগর, রকি, শিবা সানু খলচরিত্রে অভিনয় করছেন ঠিকই, কিন্তু তা ছকে বাঁধা অভিনয়ের বাইরে গিয়ে অনেকক্ষেত্রেই শিল্পিত রূপটা পায়নি। আবার, আহমেদ শরীফ, মিজু আহমেদ, নাসির খান, সাদেক বাচ্চু¾এরা বয়স অনুযায়ী চরিত্র না পাওয়া ও অন্যান্য নানা কারণে চলচ্চিত্রে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। এই রকম একটা সময়ে ডিপজল তার ‘‘ভয়ঙ্কর’’ চেহারা নিয়ে হাজির হন তেজীতে। অনেকদিন পর দর্শকেরা রাজীব, হুমায়ুন ফরীদির পর অন্য কোনো খলনায়ককে গ্রহণ করেন। তবে ডিপজল যখন ভিলেন হিসেবে তুঙ্গে, তখন বাংলা চলচ্চিত্রে ‘‘অশ্লীলতা’ ও কাটপিসের সময় চলছিলো। ফলে ডিপজল অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোতে ‘‘অশ্লীলতা’ দেখা যায়। রাজীব কিংবা হুমায়ুন ফরীদি যে জায়গাটায় মুক্ত, ডিপজল সেখানে অভিযুক্ত হন।

জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে একদিকে রওশন জামিল আর অন্যদিকে সবাই। এই খল অভিনয় করে তিনি পুরো চলচ্চিত্রে নিজের দাপট বিস্তার করেন। তবে পরবর্তীকালে তাকে সেভাবে আর খলচরিত্রে না দেখা গেলেও বাংলা চলচ্চিত্রে মায়া হাজারিকা, রিনা খানকে খলচরিত্রে দেখা যায়। বিশেষ করে দজ্জাল শাশুড়ি, ননদ¾এসব চরিত্রে এরা অতুলনীয় অভিনয় করেন। বর্তমানে এই সব খল নারী-চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেত্রীরও সঙ্কট রয়েছে। একইসঙ্গে বলা যায়, বর্তমানে নির্মিত চলচ্চিত্রে এমন চরিত্রও তৈরি হচ্ছে না। নায়ক-নায়িকা সর্বস্ব কাহিনিহীন চলচ্চিত্রে এই সব চরিত্র রাখা হচ্ছে না।

বাংলা চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতার কথা বললেই সাইফুদ্দিন, হাসমত, রবিউল, টেলি সামাদ, দিলদার এদের নাম চলে আসে। এদের মধ্যে শুধু টেলি সামাদই জীবিত। ফলে চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতারও অভাব রয়েছে। বিনা কারণে মানুষ হাসাতে গেলে অভিনেতার মধ্যে রসবোধের উপস্থিতি থাকা দরকার। পালাবি কোথায় চলচ্চিত্রে খলনায়ক হুমায়ুন ফরীদির হাস্যরসাত্মক অভিনয় মনে রাখার মতো।

৭.

অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই চলচ্চিত্রের প্রাণ। চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য ভালো হলেও যদি অভিনেতা-অভিনেত্রী ভালো অভিনয় না করে, তাহলে তা দর্শকনন্দিত হয় না। চলচ্চিত্রের কাহিনি বাস্তবধর্মী, ফ্যান্টাসি, রোমান্টিক¾যাই হোক না কেনো, যদি কলাকুশলীরা অভিনয় করে তা ফুটিয়ে তুলতে না পারে, তাহলে চলচ্চিত্র এক অর্থে ব্যর্থ হয়। আরেকটি কথা মনে রাখা জরুরি, চলচ্চিত্র শুধু নায়ক আর নায়িকা¾এই দুই চরিত্র ঘিরেই হয় না। অনেকগুলো চরিত্র একটা ঐকতান সৃষ্টি করতে পারলেই তা সফল চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। তাই পর্দায় চরিত্রের স্থায়ীত্বকাল স্বল্প হলেও এর সঙ্গে মিশে যাওয়াই গুণী কুশীলবের কাজ। আর এই জায়গাটাতেই বাংলা চলচ্চিত্র সঙ্কটে পড়েছে।

চরিত্রানুযায়ী অভিনেতা-অভিনেত্রী না পেয়ে যাকে খুশি তাকে দিয়ে চরিত্র রূপায়ণ এবং গ্ল্যামার সর্বস্ব নায়ক-নায়িকা হাজির করে চলচ্চিত্র-নির্মাণ হলেও, তা শিল্পী সঙ্কটের দুরবস্থাকেই হাজির করে। বিভিন্ন রিয়েলিটি শোর মধ্য দিয়ে নায়ক-নায়িকা হয়ে যারা চিত্রজগতে আসেন, তারা নায়ক-নায়িকা তকমা পান ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিনয়শিল্পী হয়ে উঠেন না। ফলে গ্ল্যামার দিয়ে নির্দিষ্ট একটা সময় চললেও যখন তা শেষ হয়ে যায়, তখন অন্য কোনো চরিত্রে অভিনয় করা আর তাদের দ্বারা সম্ভব হয় না। অভিনয়ের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের প্রবৃত্তি না থাকায় যখন তখন নায়ক-নায়িকা হাজির করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য পরিচালক ও প্রযোজক উভয়ই দায়ী। সবাই তো আর এহতেশাম-এর মতো পরিচালক ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না যে চাইলেই নতুন নায়ক-নায়িকা হাজির করতে পারে।

লেখক : মাসুদ পারভেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ান। গল্পকার রানার নামে ছোটো কাগজের সম্পাদক। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের নাম ‘ঘটন অঘটনের গল্প’ ও ‘বিচ্ছেদের মৌসুম’।

parvajm@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. ভট্টাচার্য, ড. সাধনকুমার (১৯৯৪ : ১৫); নাট্যতত্ত্ব মীমাংসা; করুণা প্রকাশনী, কলকাতা।

২. প্রাগুক্ত; ভট্টাচার্য, ড. সাধনকুমার (১৯৯৪ : ১৬)।

৩. প্রাগুক্ত; ভট্টাচার্য, ড. সাধনকুমার (১৯৯৪ : ৩৫)।

৪. প্রাগুক্ত; ভট্টাচার্য, ড. সাধনকুমার (১৯৯৪ : ৩৭)।

৫. প্রাগুক্ত; ভট্টাচার্য, ড. সাধনকুমার (১৯৯৪ : ৩৮)।

৬. প্রাগুক্ত; ভট্টাচার্য, ড. সাধনকুমার (১৯৯৪ : ৩৯)।

৭. প্রাগুক্ত; ভট্টাচার্য, ড. সাধনকুমার (১৯৯৪ : ৪৮)।

৮. হায়াৎ, অনুপম (১৯৮৭ : ১); বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস; বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, ঢাকা।

৯. প্রাগুক্ত; হায়াৎ, অনুপম (১৯৮৭ : ৫)।

১০. প্রাগুক্ত; হায়াৎ, অনুপম (১৯৮৭ : ৫)।

১১. প্রাগুক্ত; হায়াৎ, অনুপম (১৯৮৭ : ২২)।

১২. প্রাগুক্ত; হায়াৎ, অনুপম (১৯৮৭ : ৪৪)।

১৩. প্রাগুক্ত; হায়াৎ, অনুপম (১৯৮৭ : ৬৩)।

১৪. ‘‘মুখ ও মুখোশের তিন মুখ’; প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০০৯।

১৫. ‘‘ইতিহাসের নায়কের প্রস্থান’; কালের কণ্ঠ, ১ আগস্ট ২০১১।

১৬. ‘‘ভালো নেই অঞ্জু ঘোষ’; বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ এপ্রিল ২০১৫।



বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন